বাঁশ দিয়ে পর্দা : জীবিকা নির্বাহের এক নতুন মাধ্যম
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৮-০২-২০২৫ ০৪:৪০:৩০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৮-০২-২০২৫ ০৪:৪০:৩০ অপরাহ্ন
ছবি: সংগৃহীত
শীতল সকাল, ঘড়িতে কেবল ৮টা বাজতে চলেছে। চারপাশে লোকজন গিজগিজ করছে। যে যার কাজে যাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছিল, হাঁকডাক আর রিকশার টুংটাং শব্দ। বিরক্ত সেই সমাগমের মধ্যেই আপন মনে একজন কী যেন করছিলেন। রাস্তার ফুটপাতে চলছিল তার কর্মযজ্ঞ। চোখ পড়ার কারণ সবার মতো তিনি কর্মচঞ্চল ছিলেন না। আস্তে আস্তে চলছিল তার হাত। হাত ঘুরিয়ে সুতার পোটলা জড়াচ্ছিলেন একটি ইটের টুকরায়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার চোখ, পুরো মনোযোগ গেঁথে আছে ওই কাজে।
কাছে যেতেই চোখ আটকে যায়। শুরু হয় কথা। জানা যায়, তিনি বাঁশ দিয়ে জানালার পর্দা তৈরি করছেন। কড়াইলের মধ্যে, রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়েই কাজ করা এই বৃদ্ধের নাম মোহাম্মদ হারুন মিয়া। বয়স ৭০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর কড়াইল এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন প্রায় ৫০ বছর হলো। গত ৩০ বছর ধরে বাঁশ দিয়ে পর্দা বুননের কাজ করছেন তিনি। এটিই তার পেশা। শুধু পেশাই নয়, নেশাও। এ কাজে আছে শিল্পসত্তা, জন্মেছে মায়া। বাঁশ আর সুতায় জড়ানো পেশাটিকে তিনি ধরে রেখেছেন, এ কাজ তাকে শিল্পীর মর্যাদা দেয় বলে।
রাজধানীতে কড়াইলের অবস্থান বনানীর খুব সন্নিকটে। তবে এলাকাটির পরিবেশে বনানীর ছোঁয়া নেই। বলা হয়, রাজধানী ঢাকার শহর ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, হৈ-হুল্লোড়, ধুলা-বালির ওড়াউড়ি, ট্রাক-রিকশার পমপম ধ্বনি, মাছ-সবজি বিক্রির হাঁকডাক এখানকার নিত্যসঙ্গী। তেমনই এক পরিবেশে দাঁড়িয়ে শিল্পসত্তা চলে কীভাবে?
কাজের সঙ্গে সঙ্গে কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছিলেন হারুন মিয়া। জানালেন, সবার কাছে এটি শুধু কাজ হলেও তার কাছে প্রিয় শিল্পকর্ম। কাজের সময় কোনো কিছুই তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। যে কোনো অবস্থাতেই কাজ চালাতে পারেন। ঝড়-বৃষ্টি এলে কাজ গুটিয়ে নিতে হয়। এ ছাড়া রোদ-শীত-আওয়াজ কোনো কিছুই কাজের ক্ষতি করতে পারে না। কর্মীর মন যদি কাজে থাকে, এসব বিষয় কোনো ব্যাপার না।
হারুন মিয়া বলেন, ‘এ কাজ জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস। তবে তরুণ বয়সে যখন কাজে জড়াচ্ছি, এ কাজে আমার মন ছিল না। আব্বা করতেন, দেখতাম। দেখে দেখে শেখা হলেও নিজে খুব একটা করতাম না। এ কাজে জড়ানোর আগে বাস-ট্রাকে কাজ করেছি, কারখানায় চাকরি করেছি। আরও নানা কাজ করেছি, বারবার পেশা বদলেছি। তবে শান্তি পাইনি। এক সময় বুঝলাম, এই শিল্পসত্তা আমাকে টানছে। এই কাজে বাবার ছোঁয়া আছে। যেহেতু কাজটা জানা ছিল; সেহেতু পুরোপুরি এ কাজই শুরু করি। এরপর কেটে যায় ৩০ বছর।’
তিনি জানালেন, একসময় এ কাজ তিনি করতেন জীবিকার প্রয়োজনে। এখন জীবিকার পাশাপাশি অভ্যাস। ৬ মেয়ে ও ১ ছেলের এই জনক রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই কাজ করেন। ছেলে-মেয়েরা এই বয়সে কাজ করতে নিষেধ করেন অথবা কমিয়ে করতে বলেন। কিন্তু কাজ বন্ধ রাখলে তার ভালো লাগে না। তার ভাষ্য, ‘যেদিন এগুলো না ধরি, সেদিন যেন ঘুমই আসে না।’
হাস্যোজ্জ্বল হারুন মিয়া বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে পর্দার কাজ হলেও এগুলো শোভা বাড়ায় যে কোনো বড় অঙ্গনের। বেশ মানানসই লাগে। বাঁশের পর্দাগুলো ব্যবহার হচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁ কিংবা সাহেবদের ড্রয়িং রুমে। দারুণ নান্দনিক পর্দাগুলো। এ কাজ স্বাভাবিক কাজ নয়, এক সুনিপুণ শিল্পকর্ম। বাঁশের চাকতিতে সুতার নকশা করে করে নানা ফুল-লতা ফুটে ওঠে। সৌন্দর্য যতটা বাড়বে; মূল্য বাড়বে ততটা। পুরোপুরি প্রস্তুত হলেই ৬০-১৫০ টাকা স্কয়ার ফুট হিসেবে বিক্রি হয় এগুলো।’তিনি জানান, বাঁশের এ পর্দা ঘরের ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এর ফাঁক দিয়ে সূর্যের তির্যক আলো মৃদু আলো হয়ে ঘরে আসে। তেমনই বাতাসও চলাচল করতে পারে। তাই এ পর্দার বেশ জনপ্রিয়তা।
একাগ্রচিত্তে বাঁশের কাঠিতে ফুল তুলে যাচ্ছেন হারুন মিয়া। সংবাদকর্মীর সঙ্গেও কথা থেমে যায়। ফের কাজে মনোযোগী, হাত চলে, একটুও ভুল নেই। পুরো পাটিতে জন্ম নেয় ‘সুতোর শিল্প’। সেই নিখাদ নকশা প্রমাণ দেয়, শিল্পসত্তা পরিবেশ-প্রতিবন্ধকতাকেও হার মানায়। চেষ্টার অসাধ্য কিছুই নেই, কাজের প্রতি ভালোবাসা জন্মালে সেই কাজ জীবসত্তার সঙ্গেই মিশে যায়।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স